আজ পশ্চিমবঙ্গ দিবস, বাংলার বইতে পড়ানো হয় না বাঙালি হিন্দু হোমল্যান্ড তৈরির ইতিহাস
নিজেদের ভারতীয় পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে না এমন মানুষ পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া দুষ্কর। তবে এই পরিচয় যে আরব সাম্রাজ্যবাদের গহ্বরে তলিয়ে যেতে বসেছিল তার ইতিহাস জানা লোক খুঁজে পাওয়ার মুশকিল। আসলে আজ বাঙালি হিন্দুরা যে নিজেদের ভারতীয় বলে পরিচয় দিতে পারে তার পেছনে রয়েছে বিরাট ইতিহাস। আজ অর্থাৎ ২০ জুনের তাৎপর্য এই ইতিহাসকে কেন্দ্র করেই। বাঙালি হিন্দু গরিমার পুনরুত্থানের দিন এই ২০ জুন। অনেক রক্তক্ষয় সংগ্রামের ফসল আজকের পশ্চিমবঙ্গ। আজ বাঙ্গালীর ভারতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার দিন। কিন্তু বাঙ্গালা ও বাঙ্গালী আজ খণ্ডিত। কিন্তু কেন খণ্ডিত? কী কারণে এই খণ্ডিত ভূমি?
সেটা জানতে হলে বেশ অনেকখানি পিছিয়ে যেতে হবে। সাল ১৯০৫, রাজ্যপাট সামলাচ্ছে সাদা চামড়ার বিজাতীয় ব্রিটিশ। বর্তমান বিহার, ওড়িশা, অসম, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে তৎকালীন অখণ্ড বঙ্গদেশ এবং সমগ্র দেশের রাজধানী তখন কলকাতা।শুধু সমগ্র দেশের রাজধানীই না, কলকাতা ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মূল কেন্দ্রও আর বাঙ্গালী হিন্দুরা ছিল সেই আন্দোলনের মুলে। অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন চন্দ্র পাল, পুলিন বিহারী দাশের মতন বিপ্লবী হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতারা ছিলেন অগ্রগণ্য।
কার্জন ভাবলো বাঙ্গালাকে ভেঙ্গে দিতে পারলে তবেই আন্দোলনের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। আনলেন ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব। যার ফল হলো দীর্ঘকালীন ক্ষোভ, বিক্ষোভ, বছরব্যাপী নরম ও গরম দুই দলের আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির বাঁধন সুদৃঢ় করতে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করলেন। কিন্তু অচিরেই তাঁকে ভুল প্রমাণ করে অবিভক্ত বঙ্গের মুসলিম সমাজের সমর্থনে পরবর্তীতে দেশভাগের কাণ্ডারী মুসলিম লীগের জন্ম হলো।
ঢাকায় যারা লীগের ভিত্তি স্থাপনা করলেন, তারা হলেন ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ, আগা খাঁ সহ বেশ চর্চিত প্রভাবশালী ব্যক্তিবৃন্দ।
তারপর দীর্ঘ ৬ বছরব্যাপী অনুশীলন, যুগান্তর, আত্মোন্নতি সমিতি প্রভৃতি বিপ্লবী সংগঠনের সমষ্টিগত চেতনার ফসল হিসেবে এই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যে বাঙালিদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন হয়েছিল, তার ফলে ১৯১১ সালে সেটি রদ করতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। ফলস্বরূপ, পরের বছর রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে যায় দিল্লীতে।
অন্যদিকে এই আন্দোলনের ফলে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে বাংলাভাষী মুসলমানরা মূলত পুর্ববঙ্গে বাঙ্গালিদের উপর বিভীষিকা নামিয়ে আনে। লাল ইস্তাহার নামক কুখ্যাত প্রচারপত্র ছাপিয়ে ময়মনসিঙ্ঘ, বরিশাল, রাজশাহী, পাবনা থেকে বাঙ্গালি হিন্দু নিধন ও বিতাড়ন শুরু হয়। পরবর্তী তিন দশকে অবিরাম ছোট বড় হিন্দু গণহত্যা চলতে থাকে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯২৪ এর পাবনা গণহত্যা, ১৯৩০ এর ঢাকা কিশোরগঞ্জ গণহত্যা ইত্যাদি। ৯৪০ সাল, স্থান এবার লাহোর। মুসলিম লীগ একটা প্রস্তাব জনগণের সামনে আনলো। সেদিন যিনি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন তিনি “ব্ল্যাক শিপ অব বরিশাল” নামে খ্যাত। কে তিনি?
তিনি ১৯৩৭ এ বাঙ্গালার প্রধানের পদ অলঙ্কৃত করা বরিশালের আবুল কাশেম ফজলুল হক। সেদিনের প্রস্তাব ছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধ, বালুচ এবং পূর্বে বাঙ্গালা সহ অসম নিয়ে গঠিত হবে ইসলামী রাষ্ট্র।
১৯৪৬ সাল, ৯ ই আগস্ট বোম্বাই থেকে আওয়াজ দিলেন জিন্না, “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস” বা ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালনের। যদিও হিন্দু মহাসভার গোপাল মুখার্জি, যুগল ঘোষদের অসামান্য বীরত্বের সামনে মুসলিম লীগ পর্যুদস্ত হয় ও কলকাতা বেঁচে যায়।
কলকাতাকে দখল করতে না পারার ব্যর্থতায় জ্বলতে থাকা মুসলিম লীগ প্রতিশোধ নিতে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালীতে ঠিক আর দুই মাস বাদেই শুরু করে হিন্দু গণহত্যা। কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিনটি বেছে নেয় তারা। গ্রামের হিন্দু মহাসভার নেতা রাজেন্দ্রলাল রায়কে হত্যা করা হয়, ধর্ষণ করা হয় গ্রামের মেয়েদের। পা দিয়ে মুছে দেওয়া হয় সিঁথির সিঁদুর। আক্রমণের তালিকায় ছিলো নমশূদ্র, কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষেরা। আজও নোয়াখালী গণহত্যার কথাটি শুনলে চোখ ভারী হয়ে আসে।
এই হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতায় বিচলিত হয় বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখার্জির সুযোগ্য জ্যেষ্ঠপুত্র হিন্দু মহাসভার নেতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি গঠন করেন বেঙ্গল পার্টিশন লীগ। ১৯৪৭ সালে হুগলী জেলার শৈবপীঠ তারকেশ্বরের সভা ডাকে হিন্দু মহাসভা। সভার বিষয় বাঙ্গালী হিন্দুর পৃথক হোমল্যান্ড বা পশ্চিমবঙ্গ গঠনের রূপরেখা প্রতিষ্ঠা। লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জির পিতা নির্মলচন্দ্র চ্যাটার্জি ছিলেন সভাপতির আসনে। তিনি বলেছিলেন, “বাঙ্গালা ভাগ বাঙ্গালী হিন্দুর কাছে জীবন-মরণের প্রশ্ন”।
তারকেশ্বর সভায় ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রাক্তন মেজর কর্নেল এ.সি.চ্যাটার্জী। প্রতিটা বাঙ্গালী হিন্দুর ঘরে ঘরে দুর্গের ডাক তিনি দিয়েছিলেন। এপ্রিলের আগে মার্চ মাসে কলকাতার এক সভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বাঙ্গালা ভাগ এবং বাঙ্গালী হিন্দুর পৃথক হোমল্যাণ্ডের স্বপক্ষে বক্তব্য রাখেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন সেই প্রস্তাব সমর্থন করেন।
রাজন্যবর্গের মধ্যে ছিলেন বর্ধমানের উদয় চাঁদ মেহতাব এবং কাশিম বাজারের শ্রীশ চন্দ্র নন্দী। এছাড়া তৎকালীন বঙ্গীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ৪ ঠা এপ্রিল যে প্রস্তাব পেশ করেন, তাতে তারা বাঙ্গালা ভাগের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। এই কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়, ক্ষীতিশচন্দ্র নিয়োগী এবং নাড়াঝোল রাজবাড়ীর বংশধর কুমার দেবেন্দ্রলাল খাঁ এবং পি এন ব্যানার্জি।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষক নেতা এবং নেতাজির বাল্যবন্ধু হেমন্ত সরকার এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মিলে তৈরী করেন “বেঙ্গল পার্টিশন লীগ”। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার, উত্তরবঙ্গের তপশিলি নেতা প্রেমহরি বর্মণ এবং মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা প্রমথরঞ্জন ঠাকুররা ছিলেন সম্পূর্ণ সমর্থনে। এছাড়া ছিলেন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের সাংসদ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, ড: রমেশ চন্দ্র মজুমদারদের মতন ব্যক্তিত্বরাও।
ওনারা বাঙ্গালী হিন্দুর হোমল্যান্ড হিসেবে একটি রাজ্য গঠনের দাবি রাখেন, যে অংশটি থাকবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তৎকালীন বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা একটি গ্যালোপ পোল প্রকাশ করে, যাতে দেখা যায় তৎকালীন শতকরা ৯৩ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাগ অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষে। এছাড়াও যুগান্তর, দৈনিক বসুমতীর মতো প্রথম সারির পত্রপত্রিকাগুলোও বাংলা ভাগের স্বপক্ষে এগিয়ে আসে
এরপর, সর্বদল সমর্থিত প্রস্তাবটি বঙ্গীয় বিধানসভায় যথাক্রমে ৫৮ ও ২১ ভোটে পাস হয় — গৃহীত হয় বাঙ্গালী হিন্দুর হোমল্যান্ডরূপে পাহাড় থেকে মোহনার ভূখণ্ড — পশ্চিমবঙ্গ।
পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ। ডঃ যদুনাথ সরকার পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পরেই এক বিখ্যাত মন্তব্য করেছিলেন যা বর্তমান ইজরাইলের সাথে তুলনা দেওয়া চলে। মোঘল আক্রমণ প্রতিহত করা যশোর রাজ প্রতাপাদিত্যের মৃত্যুর ৩০০ বছর বাদে বাঙ্গালী হিন্দুর লড়াইয়ের ফসল সনাতন বাঙ্গালী হিন্দুর হোমল্যান্ড — পশ্চিমবঙ্গ।
স্টকহোম সিনড্রোমে প্রবলভাবে আক্রান্ত সেক্যুলার বাঙ্গালীর ভুলে যাওয়া উপাসক “ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়”-এর দুই লাইন না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তিনি বলেছিলেন,
“যাহা শিখো , যাহা শুনো, যাহা মানো….
হিন্দু থাকিও, বাঙালি থাকিও ” ..।
ভাগ্যিস এনারা ছিলেন, নাহলে আজ বাংলাদেশের হিন্দুদের মতোই অসহায় অবস্থায় কাটাতে হতো পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে অনেকের আশঙ্কা আবারও হতে পারে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। আবারও কোনঠাসা হচ্ছে বাঙালি হিন্দুরা। এমন আশঙ্কার জন্য মুলত দুটি কারণকে দাবি করা হচ্ছে। প্রথমত বাঙালি হিন্দুদের নিজেদের ইতিহাস ভুলে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক নেতাদের তোষণের ছত্রছায়ায় শক্তি বৃদ্ধি করছে হিন্দু বিরোধী শক্তি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:- সৌভিক বিশ্বাস